শ্রীলক্ষ্মী হলেন সনাতনীদের একজন আরাধ্য দেবী। তিনি ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তিনি শ্রীবিষ্ণুদেবের পত্নী। তার অপর নাম মহালক্ষ্মী।জৈন সহ আরো অনেক ধর্মের ধর্মীয় স্মারকগুলিতেও শ্রীলক্ষ্মীর ছবি দেখা যায়।শ্রীলক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচা।
২০২০ সালের লক্ষ্মী পূজার সময়সূচি
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতেঃ
- পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ-বাংলা তারিখ: ১৩ কার্তিক শুক্রবার ১৪২৭। ইংরেজি তারিখ: ৩০ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০২০। সময়: সন্ধ্যা ০৫টা ৪৬ মিনিট।
- পূর্ণিমা তিথি শেষ-বাংলা তারিখ: ১৪ কার্তিক, শনিবার ১৪২৭ ।ইংরেজি তারিখ: ৩১ অক্টোবর, শনিবার ২০২০ । সময়: রাত ৮টা ১৯ মিনিট পর্যন্ত। পূর্ণিমার নিশিপালন ও শ্রী শ্রী কোজাগরী লক্ষ্মীপুজা ১৩ কার্তিক (৩০ অক্টোবর) শুক্রবার।
গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতেঃ
- পূর্ণিমা তিথি আরাম্ভ (বাংলা তারিখ) : ১৩ কার্তিক শুক্রবার ১৪২৭।
- ইংরেজি তারিখঃ ৩০ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০২০। সময়: সন্ধ্যা ০৫টা ১৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ড।
- পূর্ণিমা তিথি শেষ (বাংলা তারিখ) ১৪ কার্তিক, শনিবার ১৪২৭ ।
- ইংরেজি তারিখ: ৩১ অক্টোবর, শনিবার ২০২০ । সময়: রাত্রি ৭টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত। পূর্ণিমার নিশিপালন ও শ্রী শ্রী কোজাগরী লক্ষ্মীপুজা- ১৩ কার্তিক (৩০ অক্টোবর) শুক্রবার।
শ্রীলক্ষ্মীদেবীর ধ্যানমন্ত্রঃ-
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
==অর্থঃ দক্ষিণহস্তে পাশ, অক্ষমালা এবং বামহস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রীরূপা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা, ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণহস্তে বরদাত্রী দেবীকে ধ্যান করি।
আবাসঃ-বৈকুণ্ঠ মন্ত্র
ওঁ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ
গায়ত্রী মন্ত্র : ওঁ মহালক্ষ্ম্যৈ বিদ্মহে মহাশ্রীয়ৈ ধীমহি তন্নোঃ শ্রী প্রচোদয়াৎ।
প্রনাম মন্ত্র : ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্ব্বত পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমহস্তুতে।।
দেবী লক্ষ্মীর সৃষ্টি এবং অবতারঃ
পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণুর স্ত্রী দেবীলক্ষ্মী ধন, সমৃদ্ধি ও কামনা-বাসনার দেবী। যদিও, শ্রীলক্ষ্মী বস্তুগত সম্পদের দেবী রূপে ততোধিক বিবেচিত হন না, বরং তাকে শ্রী, উৎকর্ষ, সৌভাগ্য, সুখ ও মহত্বের দেবী রূপেই পূজা করা হয়।
১. দেবীপুরাণ মতে
দেবী লক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগু ও খ্যাতির কন্যা। তিনি শ্রী, কমলা, লক্ষ্মী, পদ্মা আদি নামে অভিহিত। তিনি মহাবিষ্ণুবক্ষস্থিতা মহালক্ষ্মী।দেবী লক্ষ্মী জন্মের পর সমুদ্রে গমন করেন এবং পৃথিবীপালক শ্রীবিষ্ণুকে প্রাপ্ত করবার জন্য গভীর ধ্যান শুরু করেন।শ্রীবিষ্ণুদেবের কথায় সকল দেবতাগণ ছদ্মবেসধারণ করে শ্রীলক্ষ্মীর নিকট গেলেন কিন্তু শ্রীলক্ষ্মী সকলকেই বিশ্বরুপ দেখাতে বলেন কারণ একমাত্র বিষ্ণুদেবই বিশ্বরুপ দর্শন দিতে পারতেন।
অবশেষে বিষ্ণুদেব স্বয়ং এসে শ্রীলক্ষ্মীকে পত্নীরুপে বরণ করেন এবং বৈকুন্ঠে নিয়ে যান।শ্রীলক্ষ্মী দেবী বিষ্ণুদেবের সহধর্মিণীরুপে ধন-সম্পদ এবং শ্রী ও সুন্দরর্তের দেবী। পরে দুর্বাসা মুনির অভিশাপে শ্রীভ্রষ্ট ইন্দ্রাদি দেবগণ সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীকে পুনরুদ্ধার করেন।
দেবী লক্ষ্মী সত্যযুগে নারায়ণের সঙ্গে লক্ষ্মী, ত্রেতাযুগে রামের সঙ্গে সীতা, দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের সঙ্গে রুক্মিণীরূপে জন্ম নিয়ে অবতরণ করেছিলেন। কলিযুগে তিনি কল্কি অবতারের পত্নী, বৃহদ্রথ রাজার কন্যা পদ্মারূপে জন্ম নেবেন।।
২. কালীকাপুরাণ মতে
কালীকা পুরাণ মতে দেবী শ্রীলক্ষ্মীর সৃষ্টিকাহিনী কিছুটা ভিন্ন।এখানে বলা হয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির প্রাকঃকালে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া স্বীয় ক্ষমতা বলে দেবী কালীকারুপে আত্নপ্রকাশ করলেন।মহাশক্তির আরেকরুপ দেবাদিদেব মহাদেব রুপে আত্নপ্রকাশ করলেন।এরপর মহাদেবী কালিকা এবং মহাদেবের শক্তিতে শ্রীবিষ্ণুদেবের আবির্ভাব ঘটলো।
শ্রীবিষ্ণুদেবের নাভিদেশ থেকে ব্রহ্মাদেবের উৎপত্তি হলো।তখন জীবজগত সৃষ্টির সময় দেব ব্রহ্মা নিলেন সকল কিছু সৃষ্টির দায়িত্ব।সকল সৃষ্টিতে বুদ্ধি,বিদ্যা ও মেধার প্রয়োজন অবশ্যই হবে।তখন দেবী মহামায়া তার অংশ থেকে দেবী স্বরস্বতীকে সৃষ্টি করলেন।দেব ব্রহ্মা তাকে নিজ কণ্যারুপে স্বীকৃত করলেন।শ্রীমহাবিষ্ণু সৃষ্টির পালনের দায়িত্ব নিলেন।সকল সৃষ্টি পালনের জন্য অবশ্যই সম্পদ,শ্রী এবং ঐশ্বর্য্যের প্রয়োজন পড়বে।
তখন মহামায়া নিজ অংশ থেকে দেবী লক্ষ্মীকে সৃষ্টি করলেন এবং শ্রীলক্ষী বিষ্ণুদেবের স্ত্রীরুপে বরেণ্য হলেন।দেবী মহামায়া স্বয়ং মহাদেবের স্ত্রীরুপে নিজেকে পার্বতীরুপে প্রকাশ করলেন।যেহেতু দেবীমহামায়ার থেকে শ্রীলক্ষ্মীদেবীর সৃষ্টি আর দেবীমহামায়ার রুপ হলেন দেবী দূর্গা সেজন্য বাংলার অধিকাংশ স্থানে দূর্গাপূজার সময় দেবী লক্ষ্মীকে দেবী দূর্গার কণ্যারুপে পূজা করা হয়।তবে বাংলার বাইরে দূর্গা পূজায় দেবীলক্ষীকে তেমনভাবে দেবীদূর্গার কন্যারুপে ধরা হয় না।আর এমনিতেও দেবী লক্ষ্মী যে দেবী দূর্গার কন্যা এ নিয়ে তেমন কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না।
দেবী লক্ষ্মীর বিভিন্ন রুপ
অষ্টলক্ষ্মী হলেন হিন্দু ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আটটি বিশেষ শাস্ত্রীয় রূপ। তারা সম্পদের আটটি উৎস তথা লক্ষ্মীদেবীর বিভিন্ন শক্তির প্রতীক। অষ্টলক্ষ্মী লক্ষ্মীর অপ্রধান রূপভেদ। অষ্টলক্ষ্মী কর্তৃক প্রদায়িত “সম্পদ” কথাটির অর্থ হল সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, জ্ঞান, শক্তি, সন্তানাদি ও ক্ষমতা। মন্দিরে অষ্টলক্ষ্মীকে একযোগে পূজা করা হয়ে থাকে।
শ্রীঅষ্টলক্ষ্মীস্তোত্রম অনুযায়ী অষ্টলক্ষ্মী হলেন
১) আদিলক্ষ্মীঃ- লক্ষ্মীর আদিরূপ এবং ঋষি ভৃগুর কন্যারূপে লক্ষ্মীর অবতার। তিনি ‘সাগরকন্যা’ নামেও পরিচিতা। সমুদ্র মন্থনের সময় এই আদিলক্ষ্মী প্রকটিত হন এবং শ্রীবিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেন।
২) ধনলক্ষ্মীঃ- লক্ষ্মীর অর্থ ও স্বর্ণদাত্রী রূপ। অর্থাত্ তিনি সাধককে সকল বৈষয়িক সুখ ও সমৃদ্ধি প্রদান করেন।
৩) ধান্যলক্ষ্মীঃ- কৃষিসম্পদদাত্রী লক্ষ্মী, যিনি কৃষকের গৃহে নবান্নে ধান্যলক্ষ্মীরূপে পূজিতা হন।
৪) গজলক্ষ্মীঃ- গবাদি পশু ও হস্তীরূপ সম্পদদাত্রী লক্ষ্মী। এছাড়াও এই গবাদিপশু পালন থেকে যে আয় হয়, তাও গজলক্ষ্মীর কৃপা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।স্বামী চিদানন্দের মতে গজলক্ষ্মী রাজক্ষমতাও প্রদান করেন।[৪] হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, গজলক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তার হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।বসুধা নারায়ণ “গজলক্ষ্মী” শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন “গজ অর্থাৎ হাতিদের দ্বারা পূজিত লক্ষ্মী”।
৫) সন্তানলক্ষ্মীঃ- সন্তানসুখপ্রদায়িত্রী লক্ষ্মী।
৬) বীরলক্ষ্মীঃ- যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব এবং জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদানকারী লক্ষ্মী।
৭) বিজয়লক্ষ্মীঃ- বিজয় প্রদানকারিনী লক্ষ্মী, কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয় বরং জীবনের কঠিন সময়ে বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও বিজয়ালক্ষ্মী গুরুত্বপূর্ণ দেবী।
৮) বিদ্যালক্ষ্মীঃ- কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞান রূপ ধন প্রদানকারিনী লক্ষ্মী।
কোনো কোনো অষ্টলক্ষ্মী তালিকায় লক্ষ্মীর অন্যান্য কয়েকটি রূপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। নিচে তা উল্লেখ করা হলোঃ
ঐশ্বর্যলক্ষ্মীঃ-ঐশ্বর্যপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।
সৌভাগ্যাঃ-সৌভাগ্য প্রদানকারিনী লক্ষ্মী।
রাজ্যলক্ষ্মীঃ-“যিনি শাসককে আশীর্বাদ করেন এবং মূলত রাজগৃহে অবস্থান করেন।”
বরলক্ষ্মীঃ-যে দেবী সুন্দর বর বা আশীর্বাদ প্রদান করেন।।
দেবী লক্ষ্মীর বাহন
লক্ষ্মীপেঁচা। দুধসাদা ছোট্ট সেই পেঁচা নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। শিকারি পাখি পেঁচা, সে যখন ওড়ে তখন বাতাস কাঁপে না বলে শিকারও টের পায় না। সম্পদও আহরণ করতে হয় নিঃশব্দে, আর তা রক্ষাও করতে হয় অতন্দ্র ভাবে। নিশাচর পেঁচা তাই হয়তো দেবীর বাহন।।
লক্ষ্মীদেবী রুপ বর্ননা
লক্ষ্মী দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠান করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে এই দেবী বৈকুণ্ঠে পরিপূর্ণতমা শ্রেষ্ঠা মহালক্ষ্মী, স্বর্গে ইন্দ্রের সম্পদরূপা স্বর্গলক্ষ্মী, পাতাল ও মর্ত্যে রাজাদের রাজলক্ষ্মী, গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী ও অংশরূপে গৃহিনী এবং গৃহিগণের সম্পদরূপিণী মঙ্গলকারিণী মঙ্গলা।
তিনি গাভীদের জননী সুরভী, যজ্ঞের পত্নী দক্ষিণা, তিনি ক্ষীরোদ-সমুদ্রকন্যা, পদ্মফুলের সৌন্দর্যরূপিণী, চন্দ্রের শোভারূপা, সূর্যমণ্ডলের শোভারূপা এবং অলঙ্কারে, রত্নে, ফলে, জলে, নৃপপত্নীতে, গৃহে, সকল শস্যে, বস্ত্রে ও পরিষ্কৃত স্থানে বিরাজমানা।
কৃত্যতত্তম-অষ্টবিংশতিতত্ত্বমে আছে, পাশ, অক্ষমালা, পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনা, ত্রিলোকের মাতা, গৌরবর্ণা, সুরূপা, নানা অলঙ্কারে সজ্জিতা, বাম হস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণ করে বরদানকারিণী দেবীকে ধ্যান করি।
তন্ত্রসার অনুসারে দেবী চার হস্তে বরমুদ্রা, অভয়মুদ্রা ও দুইটি পদ্ম ধারণ করে আছেন। তাঁর পীনোন্নত স্তনে মুক্তার শোভা পাচ্ছে। তন্ত্রসারের অন্যত্র গজলক্ষ্মীর যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এরকম- দেবীর দেহ স্বর্ণবর্ণের। চারটি হস্তি শুড় দ্বারা অমৃতপূর্ণ স্বর্ণ-কলস তুলে অমৃতবর্ষণ করে তাঁর অভিষেক করছে। তিনি ডানদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে বরমুদ্রা এবং বামদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে অভয়মুদ্রা ধারণ করেছেন। তাঁর মস্তকে রত্নমুকুট, পরিধানে পট্টবস্ত্র এবং তিনি পদ্মে উপবিষ্টা আছেন।
চণ্ডীতে যে মহালক্ষ্মীর উল্লেখ আছে- তিনি অষ্টাদশ ভূজা। তিনি অষ্টাদশ হস্তে অক্ষমালা, পরশু, গদা, বাণ, বজ্র, পদ্ম, ধনু, কমণ্ডলু, দণ্ড, শক্তি, অসি, ঢাল, ঘণ্টা, শঙ্খ, সুরাপাত্র, শূল, পাশ ও সুদর্শন চক্র ধরে আছেন। তন্ত্ররাজ গ্রন্থে এক সিদ্ধলক্ষ্মীর কথা আছে যার কৃপায় যুদ্ধে জয়লাভ করা যায়। সে সিদ্ধলক্ষ্মীর একশত মুখ, দুইশত বাহু, প্রতিটি মুখ ত্রিনয়ন-বিশিষ্ট, ভয়ঙ্কর এবং সমান আকৃতি বিশিষ্ট শক্তি দ্বারা পরিবৃতা।
লক্ষ্মী দেবীর রূপ বিশ্লেষণ করে রজোগুণেরই আধিক্য পাওয়া যায়। হিরণ্যবর্ণ, স্বর্ণমুকুট, নানা অলঙ্কার, হস্তিদের ছেটানো অমৃত-জলে স্নান প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রকৃতির রজোগুণকেই সূচিত করে। দেবীর হাতে পদ্ম এবং তিনি পদ্মের উপর বসে থাকেন অর্থাৎ পদ্মের সাথে দেবীর একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
পদ্ম হল সূর্যের প্রতীক। আর সূর্য হল বিষ্ণুরই এক রূপ। বিষ্ণুর হাতেও পদ্ম রয়েছে। তাই বিষ্ণুশক্তি হিসেবে লক্ষ্মীর হস্তে পদ্ম থাকাটা স্বাভাবিক। আবার পদ্ম ভক্তিরও প্রতীক। দেবী ভক্তদের ভক্তি প্রদান করেন তাই ভক্তিপদ্ম তার হস্তে।
লক্ষ্মী দেবীর প্রিয় ও অপ্রিয়
লক্ষ্মী দেবীর কোন কোন স্থান প্রিয় আর কোন কোন স্থান অপ্রিয়, তা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে। দেবী বলেছেন- যে সকল গৃহে গুরু, ঈশ্বর, পিতামাতা, আত্মীয়, অতিথি ও পিতৃলোক রুষ্ট হন সে সকল গৃহে আমি প্রবেশ করি না।
আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃণা বোধ করি, যে সকল ব্যক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী, সর্বদা কেবল নাই-নাই বলে, যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল, যারা সত্যহীন মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে, বিশ্বাসঘাতক ও কৃতঘ্ন, যে সকল পাপী সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ভয়গ্রস্ত শত্রুগ্রস্ত, ঋণগ্রস্ত, অতি কৃপণ, দীক্ষাহীন, শোকার্ত, মন্দবুদ্ধি সম্পন্ন, স্ত্রী-বশীভূত, কুলটার পতি, দুর্বাক, কলহপরায়ণ, যারা ভগবানের পূজা ও তাঁর নাম-গুণাগুণ-কীর্তনে বিমুখ, যারা শয়নের পূর্বে পা ধোয় না, নগ্ন হয়ে শয়ন করে, বেশী ঘুমায় অথবা প্রভাতে।
সায়াহ্নে বা দিনে নিদ্রা যায়, যাদের দাঁত অসংস্কৃত, পরিধেয় বস্ত্র মলিন এবং হাত বিকৃত তাদের গৃহে আমি কখনো গমন করি না। আমি সে গৃহেই বাস করি, যে সকল গৃহে সাদা কবুতর রয়েছে, যেখানে গৃহিনী উজ্জ্বল ও সুশ্রী, যেখানে কলহ নাই, ধানের বর্ণ স্বর্ণের মত, চাল রূপার মত এবং অন্ন-তুষহীন।
যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ও ভোগ্যবস্ত্ত সমান ভাগ করে ভোগ করেন, যিনি মিষ্টভাষী বৃদ্ধগণকে সেবা করেন, প্রিয়দর্শন, স্বল্পভাষী, অদীর্ঘসূত্রী অথাৎ কোন কাজে অধিক সময় ব্যয় করেন না, ধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্যান, অগর্বিত, যিনি জনগণের সেবাপরায়ণ ও পরকে পীড়া দেন না, যিনি ধীরে সণান করেন, দ্রুত আহার করেন, ফুল তোলার পর গন্ধ নেন না, পরস্ত্রী দর্শন করেন না এবং সংযত সে ব্যক্তিই আমার প্রিয়।
লক্ষ্মী পূজা
শরৎকালে দুর্গাপূজার পর যে পূর্ণিমা আসে সে পূর্ণিমায় ঘরে ঘরে লক্ষ্মী দেবীর পূজা করা হয়। ঐ পূর্ণিমাকে কোজাগরী পূর্ণিমা বলা হয়। কোজাগরী অর্থ ‘‘কে জেগে আছো’’। ঐ পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীদেবী সবাইকে ডেকে বলেন ‘‘কে জেগে আছো’’। ঐ রাতে যারা জেগে থাকে তারা সকলেই দেবীর কৃপালাভ করতে পারেন।
পূজার আচার
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তার আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য।
কোনও কোনও পরিবারে পূজায় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পূজা স্থানটিকে। পূজার উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়।
ভোগ-প্রসাদ
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ভোগে অনেক বাড়িতেই জোড়া ইলিশ রাখা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি, লাবড়া থাকা আবশ্যিক। সঙ্গে প্রসাদে ফলমূল তো থাকেই , থাকে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, ভুশের নাড়ু। এছাড়াও লুচি, পায়েস, মিষ্টির নানা আয়োজন থাকে মা লক্ষ্মীর জন্য।[৫] পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে এইদিন মাছের পাঁচ পদের রান্না হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে এই দিন পুরো নিরামিষ খাওয়া দাওয়া হয় এবং চালের কোনো রান্না করা হয় না।
লক্ষ্মীদেবীর পৌরাণিক ও লৌকিক গল্প
লক্ষ্মীকে নিয়ে বাংলার জনসমাজে বিভিন্ন জনপ্রিয় গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পগুলি পাঁচালির আকারে লক্ষ্মীপূজার দিন পাঠ করা হয়। একে লক্ষ্মীর পাঁচালি বলে। লক্ষ্মীর ব্রতকথাগুলির মধ্যে “বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা” সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও “বারোমাসের পাঁচালি”-তেও লক্ষ্মীকে নিয়ে অনেক লৌকিক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা করে থাকেন। এই পূজা সাধারণত বাড়ির সধবা স্ত্রীলোকেরাই করে থাকেন। “বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা”-য় এই বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে একটি যে লৌকিক গল্পটি রয়েছে, তা এইরকম: এক দোলপূর্ণিমার রাতে নারদ বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যের অধিবাসীদের নানা দুঃখকষ্টের কথা বললেন।
লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এই সব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন।. কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখকষ্ট ঘোচাতে তিনি মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত প্রচার করতে এলেন। অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেদের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল। ধনেশ্বরের বিধবা পত্নী সেই ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন। শ্রীলক্ষ্মী তাকে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন। ধনেশ্বরের স্ত্রী নিজের পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করাতেই তাদের সংসারের সব দুঃখ ঘুচে গেল।
ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তী নগরে প্রচারিত হয়ে গেল। একদিন অবন্তীর সধবারা লক্ষ্মীপূজা করছেন, এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে তাদের ব্রতকে ব্যঙ্গ করল। ফলে দেবী লক্ষ্মী তার উপর কুপিত হলেন। সেও সমস্ত ধনসম্পত্তি হারিয়ে অবন্তী নগরে ভিক্ষা করতে লাগল। তারপর একদিন সধবাদের লক্ষ্মীপূজা করতে দেখে সে অনুতপ্ত হয়ে শ্রীলক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চাইল। শ্রীলক্ষ্মী তাকে ক্ষমা করে তার সব ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে সমাজে লক্ষ্মীব্রত প্রচলিত হল।।
রেফারেন্সঃ-
(১)দেবীপুরাণ,
(২)কালীকাপুরাণ,
(৩)The Eightfold Lakshmi (swami chidananda-1977)।
সনাতনী ডট-কমে (Sonatoni.Com) ভিসিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই পোষ্ট-টি সম্পর্কে আপনার কোন প্রশ্ন বা সাজেশন থাকলে আমাদের জনান। আমাদের জানাতে হলে নিচের কমেন্ট বক্সে লিখুন। পোষ্ট-টি ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
নোটঃ আপনি যদি সনাতনী ডট কম-এ লিখতে চান, তাহলে আমাদের ফেসবুক পেইজে মেসেজ করুন । ফেসবুক পেইজ লিংকঃ https://www.facebook.com/worldsonatoni/