আপনি জানেন কি ঋষি বিশ্বমিত্রের পুত্র “সুশ্রুত” সার্জারীর জনক

আপনি জানেন কি ঋষি বিশ্বমিত্রের পুত্র “সুশ্রুত” সার্জারীর জনক (Sushruta is Father of Surgery)? যদি না জেনে থাকেন, তাহলে ২/৩ মিনিট নিয়ে এই পোষ্ট টি পড়ুন, তাহলে জানা এবং অজানা অনেক তথ্য জানতে পারবেন।

সুশ্রুত, অথবা Suśruta ( সংস্কৃত : सुश्रुत, IAST: Suśruta, শয়নকামরা “ভাল শুনে”) একজন প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন যা সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থটির মূল লেখক হিসাবে পরিচিত। মহাভারত (Mohavarot), একটি প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য, তাকে বিশ্বমিত্রের পুত্র হিসাবে উপস্থাপন করেছে, যা সুশ্রুত সংহিতার বর্তমান সংযোজনের সাথে মিলে যায়। কুঞ্জলাল ভিসাগ্রত্ন মতামত দিয়েছেন যে এই অনুমান করা ঠিক যে সুশ্রুত যেই বংশের নাম ছিল সেটা তেই বিশ্বমিত্র ছিলেন। তিনি ” অস্ত্রোপচারের জনক ” এবং “প্লাস্টিক সার্জারির জনক” হিসাবে পরিচিত।

Sushruta Father of Surgery

সুশ্রুত সংহিতা ওষুধের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকা প্রাচীনতম গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি এবং এটি আয়ুর্বেদের একটি মূল পাঠ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থটি সাধারণ ওষুধের সমস্ত দিককেই সম্বোধন করেছে, তবে অনুবাদক জি. ডি. সিংহল সুশ্রুতকে কাজের জন্য শল্যচিকিৎসার বিশদ বিবরণ হিসাবে “অস্ত্রোপচারের জনক” বলে অভিহিত করেছেন। সুরুতার সংক্ষিপ্ত বিবরণটি বারাণসীতে তার লেখককে সনাক্ত করে।

আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগেকার কথা। বর্তমান ভারতের এখনকার বারাণসীর কাছাকাছি কোনও একটি জনপদ। একদিন মধ্যরাত্রে এক চিকিৎসকের দরজায় আকস্মিক করাঘাত। সুখ্যাত সেই চিকিৎসক দরজা খুলতেই এক ব্যক্তি একেবারে তার পায়ের উপর এসে পড়ল। অনেকখানি কাটা তার নাক দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত পড়ছে। নিজেকে পর্যটক বলে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসার জন্যে। কাতর আবেদন জানাল সে। বৎস, উঠে দাঁড়াও, ভয় পেও না’, তাকে অভয় দিলেন আয়ুর্বেদাচার্য, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন শান্ত হয়ে বসাে।

সে সময়ে কোনও গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে নাক বা কান কেটে নেওয়া হত। সম্ভবত তেমন কোনও অপরাধের শাস্তিস্বরূপ সুশ্রুতের শরণ-নেওয়া সেই আগন্তুকের নাক কাটা গিয়েছিল। আচার্য সুশ্রুত তাকে একটি মাদুরের ওপরে বসালেন, জল এবং ভেষজ নির্যাস দিয়ে তার মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে তাকে এক পাত্র মদ্য পান করালেন। রােগীটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমিয়ে পড়ল।

চিকিৎসক এ বার একটি লতা থেকে বড় মাপের একটি পাতা ছিড়ে নিয়ে তার কর্তিত নাকের ওপর বসিয়ে সেই মাপ অনুযায়ী পাতাটি চারপাশ থেকে কেটে নিলেন। এরপর রােগীর গাল থেকে ওই কর্তিত পাতার সমান করে কিছুটা মাংস আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া ধারালাে ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে সেটি তার বিকৃত নাকের ওপর বসিয়ে নাকের মতাে করেই মুড়ে দিলেন। এবং নিখুঁত সেলাই করে জুড়ে দিলেন সেই নতুন নাক।

তার আগে অবশ্য দুটি সরু নল নাকের অস্থায়ী ছিদ্র হিসেবে স্থাপন করেছিলেন সুশ্রুত। পরবর্তী ধাপে জুড়ে দেওয়া নাকের ওপর প্রয়ােজনীয় ভেষজ ওষুধের প্রলেপ দিয়ে তুলাে ও কাপড়ের সাহায্যে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। গালের যে অংশ থেকে মাংস কেটে নেওয়া হয়েছিল, সেখানেও ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল তার আগেই। এরপর রােগীটিকে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে, সেগুলি নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে। এবং কয়েক সপ্তাহ পরে ফের দেখা করতে বললেন।

এই ছিল প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শল্যবিদের চিকিৎসা পদ্ধতি। এভাবেই নাক, কান কাটা যাওয়া রােগীদের নতুন অঙ্গ বানিয়ে দিতেন তিনি। আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মেছিলেন সুশ্রুত। শােনা যায় বিশ্বামিত্র মুনির বংশধর ছিলেন তিনি। বারাণসীতে দেবদাস ধন্বন্তরির কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন সুশ্রুত। পরে শল্যবিদ্যার পাশাপাশি চিকিৎসার অন্যান্য বিভাগেও পারদর্শিতা লাভ করেন।

সুশ্রুতের আগে, বস্তুত খ্রিস্টজন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগেও ভারতবর্ষে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। কিন্তু সুশ্রুতই প্রথম এর প্রথাগত পদ্ধতির উদ্ভাবক এবং ব্যাখ্যাকার। সংস্কৃত ভাষায় লেখা তার সুশ্রুতসংহিতা’ শল্যবিদ্যা তথা প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার এক আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে শল্য চিকিৎসার ১২০ রকমের যন্ত্রপাতির উল্লেখ রয়েছে। যন্ত্রগুলি ব্যবহারের আগে প্রতি বার পুড়িয়ে নেওয়া হত, সম্ভাব্য সংক্রমণ এড়াতে।

সুশ্রুতই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম চিকিৎসক, যিনি পেট কেটে সন্তান প্রসব করানাের, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যার নাম সিজারিয়ান সেকশন’, পরামর্শ দিয়েছিলেন। মূত্রস্থলীতে জমা পাথর বের করা, দেহের ভগ্ন হাড়গােড় জুড়ে দেওয়া, এমনকী চোখের ছানি অপারেশন করতেন সুশ্রুত। আরও লক্ষণীয়, রােগীকে মদ্যপান করিয়ে তাকে আংশিক অবশ করে অস্ত্রোপচার করতেন তিনি। যাকে আধুনিক ‘অ্যানাস্থেসিয়া’ অর্থাৎ চেতনানাশকের আদি পূর্বসূরি বলা যায়।

চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন সুশ্রুত। প্রথমে লাউ, কুমড়াে, তরমুজ, শসা ইত্যাদি কেটে শিষ্যদের অস্ত্রোপচারের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। শারীরসংস্থান বুঝতে মৃতদেহ জলে ডুবিয়ে রেখে পর্বে পর্বে তার পচন ও ক্ষয় পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিতেন।

ছাত্রদের বলতেন, ভাল চিকিৎসক হতে গেলে শল্যবিদ্যা এবং ওষুধপত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আবশ্যক। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে স্বীকৃত গ্রিক দার্শনিক হিপােত্রেটিসের লেখা শপথ আজও নিতে হয় ডাক্তারির ছাত্রদের। সুশ্রুত তার প্রায় ১৫০ বছর আগেই তার শিষ্যদের জন্যে এমন শপথ চালু করেন।

ভাল চিকিৎসক হতে গেলে কীভাবে রােগীকে প্রাথমিক পরীক্ষা করতে হবে এবং রােগ নির্ণয় করে তার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, সবই বর্ণিত রয়েছে সুশ্রুত সংহিতায়। যক্ষ্মা, ফুসফুসের অসুখ, জ্বর, চর্মরােগ ইত্যাদি সহস্রাধিক রােগের উল্লেখ আছে এই মহাগ্রন্থে।

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সুশ্রুত সংহিতা আরবি ও ফারসিতে অনূদিত হয়। এবং আরবদের মাধ্যমে এক সময়ে এই বিদ্যা পাশ্চাত্যে প্রবেশ করে। উনিশ শতকে ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় এই গ্রন্থের অনুবাদ বেরয়। মাত্রই ১৯০৭ সালে কলকাতায় প্রথম ইংরেজিতে তা অনুবাদ করেছেন কবিরাজ কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন।

“সুশ্রুত” সার্জারীর জনক Wikipedia

প্রারম্ভিক পণ্ডিত রুডলফ হোর্নেল প্রস্তাব করেছিলেন যে সুশ্রুত-সংহিতা থেকে কিছু ধারণা শতপথ-ব্রাহ্মণ তে পাওয়া যেতে পারে, যা তিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর তারিখের, এবং এই ডেটিং এখনও প্রায়শই পুনরাবৃত্তি হয়। গত শতাব্দীতে, ভারতীয় চিকিত্সা সাহিত্যের ইতিহাসের উপর বৃত্তি যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর হয়েছে, এবং দৃত প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে যে সুশ্রুত সংহিতা বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্তরগুলির একটি কাজ।

এর রচনাটি খ্রিস্টপূর্ব শেষ শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল এবং এটি বর্তমান লেখায় এটির আরেকটি লেখকের দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছিল, যিনি এর প্রথম পাঁচটি অধ্যায় পুনরায় প্রেরণ করেছিলেন এবং দীর্ঘ, চূড়ান্ত অধ্যায় যুক্ত করেছিলেন, “উত্তরতন্ত্র”। সম্ভবতঃ সুশ্রুত সংহিতা পণ্ডিত দৃর্দবল ( ৩০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ) এর কাছে পরিচিত ছিলেন, যা আমাদের কাছে যে রচনাটি আজ অবতীর্ণ হয়েছে তার সংস্করণের সর্বশেষতম তারিখ দেয়। ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে এও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে “সুশ্রুত” নামে একাধিক প্রাচীন লেখক রয়েছেন যাঁদের মধ্যে বিবাদ হতে পারে।

মহাভারত সুশ্রুতকে বিশিষ্ট ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্রদের মধ্যে তালিকাভুক্ত করেছেন। বিশ্বমিত্রের সাথে একই সংযোগটি সুশ্রুত সংহিতায়ও বর্নোনা দেবা আছে। সুশ্রুত নামটি পরবর্তী সাহিত্যে বোভার পান্ডুলিপিতে (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে) প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে সুশ্রুতকে হিমালয় অঞ্চলে বসবাসকারী দশটি ঋষির মধ্যে একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

সুশ্রুত-সংহিতা

সুশ্রুত সংহিতা এর প্রচলিত আকারে, ১৮৪ অধ্যায়ে ১,১২০ টি অসুস্থতা, ৭০০ টি ঔষধি গাছ, খনিজ উত্স থেকে ৬৪ টি প্রস্তুতি এবং পশুর উত্সের ভিত্তিতে ৫ টি প্রস্তুতির বিবরণ রয়েছে। পাঠ্যটিতে শল্য চিকিত্সা, পরীক্ষা করা, বিদেশী সংস্থাগুলি নিষ্কাশন, ক্ষার এবং তাপ কৌতুককরণ, দাঁত নিষ্কাশন, ক্ষরণ, এবং ফোলা নিকাশী জন্য ট্রোকার, হাইড্রোসিল এবং অ্যাসিডিক তরল প্রসেট, প্রোস্টেট গ্রন্থি অপসারণ, মূত্রনালী স্ট্রাকচার বিচ্ছিন্নতা, ভ্যাসিকোলিথোটোমি, হার্নিয়া সার্জারি, সিজারিয়ান বিভাগ, রক্তক্ষরণ, ফিস্টুলি, ল্যাপারোটমি পরিচালনা এবং অন্ত্রের বাধা পরিচালনা, ছিদ্রযুক্ত অন্ত্র এবং পেটের দুর্ঘটনাক্রমে ছত্রাকের প্রসারণ এবং ফ্র্যাকচার ম্যানেজমেন্টের নীতিগুলি, যেমন, ট্র্যাকশন, ম্যানিপুলেশন, প্রয়োগ এবং স্থিতিশীলতা সহ কিছু পুনর্বাসন এবং সিন্থেটিক ফিটিং ব্যবস্থা।

এটি ছয় প্রকার বিশৃঙ্খলা, বারো প্রকারের ভাঙ্গন এবং হাড়ের শ্রেণিবিন্যাস এবং আঘাতের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়ার গণনা করে এবং ছানি শল্য চিকিত্সা সহ চোখের রোগগুলির শ্রেণিবিন্যাস দেয়।

Wikipedia থেকেও সঠিক তথ্য জনাতে পারবেন । Wikipedia Link

Leave a Comment