শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান (পর্ব ২) | হিন্দুধর্মের গল্প

দেশের এমনই দুর্ভাগ্য গীতাপাঠ, গীতা শ্রবণ ও গীত পুস্তক দান করাকে একদল লােক মহাপুণ্য কার্য বলে মনে করে থাকে। গীতার উপদেশ মত কাজ করার যেন প্রয়ােজনই নেই—শুধু পড়ে যাও, আর কেবল শ্রবণ করে যাও। ভারতীয় আর্যজাতি কম করে পাঁচ হাজার বৎসর ধরে তুমি গীতা পাঠ করেছ, গীতা শ্রবণ করেছ। আজ এই জন্মাষ্টমীর পবিত্র তিথিতে বলতে শুনি শ্রীকৃষ্ণের অনুকূলে তুমি কোন মহৎ কর্মটি করেছ? [adinserter block=”2″]

sri-krishna-ahban-part-

শ্রীকৃষ্ণ গীতায় মুক্তকণ্ঠে ঘােষণা করেছেন-চাতুর্ব্ণ্ৎং মযা সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ. গুণ ও কর্মানুসারে মানুষ, | সমাজের চার বর্ণে বিভক্ত হয়ে কল্যাণকর কার্যে নিযুক্ত থাকবে। যে ব্রাহ্মণের কাজ করবে সে হবে ব্রাহ্মণ ; যে ক্ষত্রিয়ের কাজ করবে, সে হবে ক্ষত্রিয় ; যে কৃষি, গাে-রক্ষা ও বাণিজ্য করবে, সে হবে বৈশ্য, আর যে অন্যান্য তিন বর্ণের সেবা করবে, সে হবে শূদ্র ; এই হল গুণকর্ম অনুসারে মানবসমাজের বর্ণ বিভাগ।

দেশশাস্ত্রও ঠিক এই নির্দেশই দেয়। এবার বলতাে গীতা পাঠকারী ও শ্রবণকারী ভক্তবৃন্দ! ভগবানের এই বর্ণ বিভাগ শুধু মুখে আওড়েছ-না, কাজেও কিছু করেছ? কাজে করলে দেশে জাতিভেদ থাকত না, মানুষে মানুষে ঘৃণা মুছে যেতাে ; কর্মকে কেহ হীন মনে করে ত্যাগ করত না। “কেবল গীতা পাঠ কর, আর লােককে শ্রবণ করাও” এই উপদেশ এমন বিকৃতভাবে গীতা, ভক্তদের পেয়ে বসেছে, যা বলতেও লজ্জা করে।

মহাবীর অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিলেন-গীতার উপদেশ। অৰ্জ্জুন যুদ্ধ করতে এসে—যুদ্ধক্ষেত্রে দেখলেন, আত্মীয় স্বজন-কুটুম্বদের। তিনি কৃষ্ণকে বলতে লাগলেন—এদের বিরুদ্ধে সংগ্রম করে আমায় রাজ্যলাভ করতে হবে? অর্জুন বিমূঢ়ের মত বলতে লাগলেন, “সখা! আমার রাজ্যভােগে কাজ নেই—আমি রাজ্য চাই না, কুটুম্ব-আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করে রাজ্যলাভ অপেক্ষা আমার ভিক্ষা করে খাওয়াই ভাল। থাক তােমার যুদ্ধ আমি যুদ্ধ করতে পারব না। আমার হাত কাঁপছে, শরীর থরথর করে উঠছেও-না-না আমি সংগ্রাম করতে পারব না।” শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন বিপদভারী। অর্জুনের মত বীরের হাত হতে গাণ্ডীব খসে পড়ে গেল। তার মত যােদ্ধা আজ কাপুরুষের মত এই হীন উক্তি করছে, ক্ষাত্রধর্ম ত্যাগ করে পরধর্মে প্রীতি দেখাচ্ছে!

অর্জুনের ক্ষাত্র বীর্যকে জাগ্রত করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ বললেন—“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ” “তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তে যুদ্ধা কৃতনিশ্চযঃ অর্জুন তােমার ক্লীবত্ব পরিত্যাগ কর, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও! অর্জুন যেন সঞ্জীবনী মন্ত্র পেয়ে, বললেন “স্থিতােহম্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব”, তােমার বাণীই আমার পালনীয়, আমি যুদ্ধ করব।

sri-krishna-ahban-part 2

সেখানে প্রবক্তা শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রোতা বীর্যবান অর্জুন, যাঁর হাতে আছে অজেয় গাণ্ডীব—আর আজ সেই গীতা কোথায় পাঠ হচ্ছে? অস্ত্রহীন হয়ে নিজে ততা পাঠ করেই, অধিকন্তু মৃত ব্যক্তির কানের কাছে গিয়ে গীতা শ্রবণ করান হয় ;-“ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।” শুধু শুনিয়ে যাও বাবা শুনিয়ে যাও। গাছপালা ঝােপ-ঝাড়, নদী-নালা যাকে পার শুনিয়ে যাও। শুনতে সক্ষম হােক বা না হােক, কিছু করুক বা না করুকশুনিয়ে যাও। মূতের বুকে গীতা স্থাপন করা হচ্ছে। যে ব্যক্তি জীবন ভর শুধু সুদ কষে এসেছে, মিথ্যা ভণ্ডামি করেছে, তাকে মােক্ষধামে প্রেরণ করার ব্যবস্থা—তার মৃত শরীরের উপর গীতা স্থাপন করে। হায়রে দেশ! হায়রে সমাজ! এ যে উল্টো বুঝলি রামের দশা হল!

গীতা শ্রবণ করাতে হবে দেশের স্বাধীনতা রক্ষাকারীকে-“হতে বা প্রাপস্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভােক্ষ্যসে মহীম-হে বীর মনে রেখাে, যদি তুমি দেশের, জাতির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতে শরীর ত্যাগ কর, তাহলে তােমার অক্ষয় স্বর্গলাভ, আর যদি বিজয়ী হও সমগ্র পৃথিবী তােমার। যারা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের পরাক্রম পাঠ করেছে, তারা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালকেই তার জীবনের সবকিছু বলে মনে করেছে।

কংসকে বালক কৃষ্ণই হত্যা করেছেন। বকাসুর, অঘাসুর, আদি যত অসুর ছিল, কৃষ্ণ তাদের একটিকেও রাখেন নাই, সবাইকে নাশ করেছেন। পুতনাবধ সেও অতি শৈশবের ঘটনা। বাল্য বয়সে এই যে অপরিসীম বীর্য, মহাপরাক্রম—তাই দেখে লােক মুগ্ধ। এও কৃষ্ণের একটা দিক্‌। বালকের দল কৃষ্ণকে নিজের মত করে ভেবেছে—কৃষ্ণ যেন তাদের কত আপন। রাখালরা রাজা-রাজা খেলেছে, রাখালের দল কৃষ্ণকে করেছে রাজা, কৃষ্ণ খেলাঘরের রাজা, তিনি রাখাল-রাজা।

কেন যে কৃষ্ণ গরু চরাতেন মাঠে মাঠে-সে কথা সাধারণ বালক কি করে বুঝবে? কৃষ্ণ এমনভাবে জনসাধারণের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, যা সাধারণ জন-মানব তার উদ্দেশ্যকে জানতে পারত না। সবাই মনে করত কৃষ্ণ আমাদের একজন। গাে-পালন করা যে বিশ্বের মহা কল্যাণকর কর্তব্য, সে কথা তিনি মুখে বলে কি করবেন—মুখে বলেই বা লাভ কি? তাই তিনি নিজে গাে-পালন করেছেন। গােধন শ্রীকৃষ্ণের বড় প্রিয়।

জীবনের প্রথম বয়স হতে তিনি গােধনকে সর্বতােভাবে রক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি প্রত্যহ সন্ধ্যা হবন ও অতিথি আদি গুরুজনদের সেবা করা ছাড়াও তের হাজার চুরাশিটি প্রথম প্রসূতা, বতী, সবৎসা, সরুল ও শান্ত-স্বভাবযুক্তা-বন্ালঞ্কার সঙ্জিতা গাভী বিপ্রদের চন করতেন। তিনি জানতেন, গােদুখধ ছাড়া মানব জাতির কল্যাণ নাই, মাখন, ্ড খযতীত সাত্ত্বিভাব জন্মে না, যেখানে সাত্ত্বিকভাব নেই সেখানে অভ্যুদয় ও কিশেস বাতুলতা মাত্রা।

আরোও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান (পর্ব ১)

শ্রীকৃষ্ণের মহান সঙ্কল্প ছিল, যে ভারতে তিনি জন্ম নিয়েছেন সেই ভারতকে-মহাভারত-বিশাল ভারতে পরিণত করা। এই সঞ্চল্প সিদ্ধির পথ কৃষ্ণকে বহু ত্যাগ ও তপস্যা করতে হয়েছিল। জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ কি শুধু বিবৃতি দিলেই হয়? তা হয় না। যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তাকে জনচিত্ত জয় করতে হবে তার চরিত্র-বলের মধ্য দিয়ে, মন বচন ও কর্মের সামঞ্জস্যপূর্ণতার মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণ-দ্বারকাধিপতি তিনি গােকুল হতে দ্বারকায় যাচ্ছেন—গােকুলবাসী নর-নারীদের ছেড়ে।

নর-নারী বেদনায় কাতর, যেন তাদের কত আপন জন গােকুল ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। গােকুলবাসীরা তাকে যেতে দেবে না। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। গােকুলের অবস্থা অবর্ণণীয়। কবি তাঁর লেখনীতে সেই বিরহ বেদনার কথা লিখতে না পেরে কল্পনাকে আশ্রয় করে লিখলেন—-

শীর্ণা গােকুল মণ্ডলী পশুকুলং শম্পায ন স্পন্দতে,
মূকা কোকিলা সংহতি শিখিকুলং ন ব্যাকুলং নৃত্যতি।
সর্বে তদ্বিরহেণ হস্ত নিতরাং গােবিন্দ দৈন্যং গতাঃ,
কিন্তোকা যমুনা কুরঙ্গ নযনা নেত্রসুভিবর্ধতে।

ধেনুনাং রুক্স শৃঙ্গীণাং সাধ্বীনাং মৌক্তিক স্রজাম্।
পর্যস্বিনীনাং গৃষ্টীনাং সবৎসানাং সুবাস।
দদৌ রূপ্য খুরাগ্রাণাং ক্ষৌমাজিন তিলৈঃ সহ।
অলংকৃতেভ্যো বিপ্রেভ্যোে বদ্ধং বদ্ধং দিনে দিনে।

শ্ৰীমদ্ভাগবৎ, দশমস্কন্ধ, ৭০ অধ্যায়

কৃষ্ণের বিরহে গােকুলের অধিবাসী শীর্ণ হয়ে গিয়েছে, গােধন আর মাঠে চরে না ; যে কোকিলের কণ্ঠে মধুর কুহুতান কুহু কুছ রবে মথুরা আমােদিত করে তুলত—সে কোকিল আজ নীরব, তাঁর সঙ্গীত আর শুনা যায় না ; ময়র জলদবরণ কৃষ্ণকে দেখে আনন্দে নৃত্য করত, সে তাে আর নৃত্য করে না-গােবিন্দের বিরহে সকলেই শীর্ণ হয়েছে, কিন্তু একমাত্র যমুনা, সে কুরঙ্গ নয়না গােকুল ললনাদের আঁখি জলে পরিপূর্ণ হয়ে স্ফীত হয়ে উঠেছে। কবির লেখনী অতিশয়ােক্তিকেও যেন ছাড়িয়ে গিয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণ এমনিই লােকপ্রিয় ছিলেন। কৃষ্ণ দূত হয়ে দৌত্য করতে চলেছেন-রথেই চলেছেন দুর্যোধনের রাজসভায়। যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পঞ্চ পাণ্ডবের জন্য মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চাই এই তার প্রার্থনা। পথের দুইদিকে অগণিত নর-নারী তাকে স্বাগত জানাচ্ছে—শঙ্খধ্বনি করে। ফুলের বর্ষা হচ্ছে কৃষ্ণের মস্তকে ও রথে ; কেহ বা তার উজ্জ্বল ভালে চন্দন চৰ্চিত করে দিচ্ছে ভক্তি-নত হৃদয়ে ; কত জয়ধ্বনি, কত উল্লাস-লােকপ্রিয় কৃষ্ণ যাচ্ছেন, নর-নারী তাকে দর্শন করে জন্য উদগ্রীব। | অভিমানী দুর্যোধন কতবার তাকে নিজ রাজসভায় ইচ্ছে করে অপমান করেছে, কৃষ্ণ হাসি মুখে তা বরণ করে নিয়েছেন, কারণ তিনি জানতেন, তাঁকে মহাভারত নির্মাণ করতে হবে।

মান-অপমান এগুলাে মানুষকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করে থাকে ; মান-অপমানের পাল্লায় পড়ে মানুষ উদ্দেশ্য হারা হয়ে যায় ; তাই তিনি এগুলােকে ভালভাবে জানতেন।* মান, অপমান, লাভ, ক্ষতি, এ সব হিসাব করার সময় আমার নেই, ইতিহাস সেগুলিকে টুকে রেখে দেবে, আর সমালােচক সেগুলিকে সমালােচনা করবে। আমার উদ্দেশ্য মহাভারত নির্মাণ। মহাভরতের অর্থ কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধ নয়,মহাভারতের অর্থ,ভারতবর্যকে বিশালরূপে রূপায়িত করা। ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রসার-দেশ হতে দেশান্তরে, দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, বিস্তৃত করতে হবে আর্য সভ্যতা। এই ছিল কৃষ্ণের তপস্যা।

শ্রীকৃষ্ণ যে, তাঁর জীবদ্দশায় মহাভারত নির্মাণ করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি পৃথিবীর সমস্ত রাজন্যবর্গকে কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গণে সমবেত করে, ভারত কলঙ্ক দুর্যোধনের-যুদ্ধ পিপাসা মিটিয়ে ছিলেন। তিনি চীন হতে ভগদত্তকে, আমেরিকা হতে বক্রবাহনকে, যুরােপ হতে বিড়ালাক্ষ প্রভৃতি মহাবীর পরাক্রমশালী যােদ্ধাদের, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন।

দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ও রাজসভায় বস্ত্র হরণ করে দুর্যোধন ও দুঃশাসন বিশ্বের নারী জাতির প্রতি যে হীন ঘৃণ্য অবমাননা প্রদর্শন করেছিল, কৃষ্ণ তারই কলঙ্ক মােচন মানসে বিশ্বের রাজন্যবর্গকে একত্রিত করে ভীমের গদায় দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ করিয়েছিলেন। আর ভীমকে দিয়েই নারীর কেশাকর্ষণ ও বস্ত্ৰহরণকারী দুঃশাসন-বক্ষের তপ্তরক্তে হস্তরঞ্জিত করিয়ে, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা মত দ্রৌপদীর বেণী-সংহার করার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়েছিলেন।

পৃথিবীর রাজন্যবর্গ। দেখে যাও, দ্রৌপদী শুধু ভারতের নারী নয়, -মহাভারতের নারী-বিশ্বের নারীজাতির একজন নারী। ট্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ও বস্ত্ৰহরণ-বিশ্বের নারীজাতির কেশাকর্ষণ ও বস্ত্র হরণ-বিশ্বের নারীজাতির

১। চীনের ভগদত্ত, আমেরিকার বকুবাহন, যুরােপের বিড়ালাক্ষ অর্থাৎ মার্জারের চক্ষুর ন্যায় চক্ষুবিশিষ্ট যুনান বা গ্রীক সমাজের যবন এবং ইরাণের শল্য প্রভৃতি রাজন্যবর্গ রাজসূয় যজ্ঞে এবং মহাভারতের যুদ্ধে আদিষ্ট হইয়া আগমন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কৃত সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস লাঞ্ছনা। ভারতবর্ষ মাতৃজাতিকে সম্মান করতে জানে, ভারত এক নারীর আবমাননাকে বিশ্বের নারী জাতির অবমাননা বলে জ্ঞান করে। তাই তাে শ্রীকৃষ্ণকে মাতৃজাতি এত ভালবাসে।

ইনিই হলেন মহাভারতের কৃষ্ণ। কি মহান আদর্শবাদী মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। আর সেই মহাপুরুষকে প্রচার করা হল”ঈশ্বর বলে! শ্রীকৃষ্ণ – কুরুক্ষেত্রের সংগ্রাম ভূমিতে বিমােহিত অর্জুনকে শ্রবণ করালেন, অর্জুন! তুমি মরার ভয় করছ? আত্মীয়স্বজন মরে যাবে ভাবছ? ‘আরে, তুমি আর আমি বহুবার জন্ম নিয়েছি, তা কি তুমি জান? জান না, তা আমি জানি। জানলে এত ক্লীবতা ও ভীরুতা তােমায় পেয়ে বসত না।

অন্ধ সমাজ গীতা পাঠ করেছে—শ্রবণ করেছে কিন্তু মনন করে নাই, কৃষ্ণের বাণীকে জীবনে প্রতিফলিত করে নাই। তিনি যে জন্ম নিয়েছেন, আবার মরবেন—আবার জন্মগ্রহণ করবেন—তার মুখের কথা শ্রবণ করে, পাঠ করেও অন্ধ সমাজ! তুমি বিশ্বাস করে নিলে তিনি জন্ম মরণাতীত ঈশ্বর! এর চেয়ে মহা-অজ্ঞানতা আর কি হতে পারে?

শ্রীকৃষ্ণ যা ছিলেন না, তাকে তাই করা হয়েছে। তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনকারীরা কলঙ্ক লেপন করেছে, মহাপুরুষের উদ্দেশ্যকে ভাষা-ভাষা ভাবে গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণকে “নারীদের সাক্ষাৎ জারস্বরূপ” বলে পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে, “ধূৰ্ত্ত পরম লম্পট বলে প্রচার করা হয়েছে, কলঙ্কলেপনকারী কৃষ্ণ ভক্ত! বল তাে শুনি, শ্রীকৃষ্ণকে তুমি কোন্ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কৃষ্ণ-চরিত্রকে উজ্জ্বল করেছ? কৃষ্ণ নাকি মথুরায় এসে কুজার সঙ্গে ব্যাভিচার

করে কুজাকে হত্যা করেছিলেন! এই হীন মিথ্যা কটুক্তি প্রচার করে বলতাে কলঙ্কলেপনকারী! কৃষ্ণকে তুমি কোন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছ? কলঙ্কলেপনকারী জেনে রেখােএসব মিথ্যা কথা। মহাভারতের রচয়িতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামে মিথ্যা অপবাদ প্রচার করে তাঁর প্রতিভা ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্রকে স্নান করতে পারবে না।

ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণকে জেনেছিলেন সম্যক ভাবে। তাই তিনি তাঁর “মহাভারতে” বলেছেন- যেখানে যােগেশ্বর কৃষ্ণ, যেখানে ধনুর্ধর পার্থ সেখানে শ্রী বিজয় ও বিভূতি অবস্থান করে। ব্যাসদেব কৃষ্ণকে বলেছেন তিনি “যােগীরাজ” আর তাকে পুরাণ-ভাগবতকার বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন কিনা কৃষ্ণ “রসরাজ”! আশ্চর্য।!

যাঁকে দর্শন করার জন্য পথের দুধারে চন্দন, মালা, গন্ধলেপন সামগ্রী নিয়ে নর-নারী আকুল আগ্রহে পথপানে তাকিয়ে থাকত, সেই কৃষ্ণকে পুরাণকার তুমি বললে চোর, জার! এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ উক্তির উত্তর চাইলে আবার শ্রীমদ্ভাগবৎকার কি বলে জানেন?”তেজস্বী পুরুষ সব পারে এতে তাদের দোষ স্পর্শ করে না” এই সব পুরাণ-ভাগবতই আজকালকার সমাজে পূজিত। ভারতবাসী আজ বিচার করে পথ চলার দিন এসেছে। যদি বিচার করে না চলাে, তাহলে আরও যে কত নীচে নেমে যেতে হবে তার বর্ণনা মুখে করা যাবে না।

শ্রীকৃষ্ণ ভারতকে মহাভারতে রূপায়িত করেছিলেন—ভারতবর্ষের ভৌগােলিক সীমারেখা ছিল বিশাল-দ্বীপ-দ্বীপান্তর বিস্তৃত। শ্রীকৃষ্ণের পূজারী, ওগাে ভারতের কোটি কোটি সন্তান! আজ বলতে শুনি, সেই শ্রীকৃষ্ণের মহাভারতকে বড় করেছ—না ছােট করেছ? বৃহত্ভারত বৃহত্তর হয়েছে, না ক্ষুদ্রতর হয়েছে? বৃহত্তর বলার কথা দূরে থাকুক, কৃষ্ণের মহাভারতকে তুমি রক্ষা করেছ একথাও মুখে বলতে পারবে কি? কৃষ্ণের মহাভারতকে তুমি ক্ষুদ্র করেছ—সঙ্কুচিত করেছ। কোথায় তােমার গান্ধার—যে দেশের গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের রাজমহিষী কোথায় লবপুর? কোথায় পুষ্পপুর? কোথায় সে পবিত্র সিন্ধু নদ? কোথায় তােমার ব্রহ্মপুত্র সঙ্গম?

আর্য জাতি! তােমার গীতা পাঠ কি ব্যর্থ হয় নাই? তুমি শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যকে বুঝতে পারাে নাই। বুঝতে পারলে মহাভারত ক্ষুদ্র ভারতে পরিণত হত না। আজ চারিদিক হতে শুধু গীতা ; গীতা, কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে চীৎকার তুললে হবে না, যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাস, তাহলে মহাভারত রচনায় প্রবৃত্ত হও। শ্রীকৃষ্ণ আত্মবিস্মৃত অর্জুনকে বারংবার বলেছেন—তস্মাৎমুত্তিষ্ঠ মশাে লভস্ব জিত্বা শত্রান ভুঙ্ক্ক রাজ্যং সমৃদ্ধ। তাহলে ওঠো, যশস্বী হবার জন্য ওঠো জাগাে। এ উপদেশ কোনও এককালের উপদেশ নয়, উপদেশ সর্বকালের। এ উপদেশ সর্ব মানবের উদ্দেশে দেওয়া উপদেশ।

শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর পুণ্য দিবসে, ওগাে! আত্মবিস্মৃত ভারতবাসী। “তম্মাৎ্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশােলভস্ব” তাহলে ওঠো, তােমার দুর্মদ-দুরন্ত সঙ্কল্প নিয়ে ওঠো-মহাভারত রচনায় অগ্রসর হও। তােমাকে মহাভারতের রচয়িতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পাঞ্চজন্য শখ বাজিয়ে আহ্বান জানাচ্ছেন—ভারতবাসী! তুমি মহাভারত রচনা কর। ওম

Leave a Comment