বৈদিক সাহিত্যে এবং চতুর্বেদের বিষয়বস্তু

যে-গ্রন্থে ধর্ম ও কল্যাণময় জীবনের কথা বলা হয়েছে তাকে ধর্মগ্রন্থ বলে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি আমাদের উল্লেখযােগ্য ধর্মগ্রন্থ। বেদ আমাদের আদি ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বেদ চিরন্তন ও শাশ্বত। ‘বেদ মানে জ্ঞান। প্রাচীন ঋষিদের ধ্যানে পাওয়া পবিত্র জ্ঞান। এ জ্ঞান হচ্ছে জগৎ-জীবন ও তার উৎস পরমপুরুষ, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান।

বেদকে কেন্দ্র করে রচিত ধর্মভিত্তিক বিশাল সাহিত্যকে বলা হয় বৈদিক সাহিত্য। আর মহাভারতের অংশবিশেষ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সংক্ষেপে গীতা হিসেবে পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। গীতায় কর্মকে যজ্ঞ বলা হয়েছে। এখানে রয়েছে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় এবং বাস্তব জীবনে চলার প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষা ও উপদেশ।

বৈদিক সাহিত্যের পরিচয়

Vedas

বেদ আমাদের আদি ধর্মগ্রন্থ। ‘বেদ মানে জ্ঞান। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রগাঢ় চেষ্টা বা সাধনার প্রয়ােজন। জ্ঞান অর্জন করতে হলে নিমগ্ন হতে হয় গভীর সাধনায়। গভীর সাধনায় নিমগ্ন হওয়াকে বলা হয় ধ্যান। যারা সত্য বা জ্ঞান এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাহাত্ম উপলব্ধি করতে পারতেন, তাদের বলা হতাে ঋষি।

বেদ এই ঋষিদের ধ্যানে পাওয়া পবিত্র জ্ঞান। এ হচ্ছে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এবং জগৎ ও জীবনের উৎস পরমপুরুষ, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান। আমাদের জীবন, জীবনের উৎস, পরমপুরুষ, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর প্রভৃতি সম্পর্কে বেদ বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থে আলােচনা করা হয়েছে।

এ গ্রন্থসমূহ ভিন্ন ধরনের হলেও ধর্মীয় নানা দিক থেকে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। এভাবেই বেদকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক এক বিশাল সাহিত্য গড়ে উঠেছে। একেই বলা হয় বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক সাহিত্যের অংশ হিসেবে যে বিষয়গুলাে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলাের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

চতুর্বেদ

বেদের এক নাম সংহিতা। সংহিতা মানে সংগ্রহ বা সংকলন। সমগ্র বেদ বা সংহিতাগুলােকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা – ১. ঋগ্বেদ-সংহিতা ২. ষজুর্বেদ-সংহিতা ৩. সামবেদ-সংহিতা এবং ৪. অথর্ববেদ-সংহিতা। এ সংহিতাগুলােকে একত্রে বলা হয় চতুর্বেদ।

Rigveda Samhita

ব্রহ্মন

বেদের দুটি অংশ – মন্ত্র ও ক্রাহ্মণ। বেসর যে-অংশে মন্ত্রের ব্যাখ্যা এবং বিজিন্ন যজ্জে তাদের এয়ােগ বা ব্যবহাকের কথা আলােচিত হয়েছে তাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়। ব্রাহ্মণঞ্জলাে পস্যে রচিত। ব্রাহ্মণেয বিষয়ব্তুর মধ্যে রয়েছে বিধি অর্থাৎ বিশেষ-বিশেষ কর্ম অনুষ্ঠানের নির্দেশ, বেদায়ে অর্থ প্রসঙ্গে প্রয়ােজনীয় ব্যাখ্যা, বিরােধী মতের সমালােচনা প্রভৃতি।

আরণ্যেক

আরণ্যেক ও উপনিষদ ব্রাহ্মণের অংশ। ব্রাহ্মণে বেদের কর্মকা্ড আলােচিন্ত হত্রেছে, আয় আর্যক ও উপনিষদে জ্ঞানকান্ড আলােচিত হয়েছে। যা অৱশ্যে রচিত তাকে আরণ্যক বলে। আরণ্যকের বিষয় ধর্মদর্শন। কার উদ্দেশে বজ্ঞ, সৃষ্টির উৎস কী ইত্যাদি আধ্যাজ্জিক বিষয় এতে আলােচিজ হযেছে। গীত না অরণ্য বা গভীর বনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ পঞ্জীয় আস্তাত্ত্বিক আলেয় বিষয় বাতে বর্ণিত আছে ভাই জয়শঙ্ক। ইয়েয় আরণ্যক, বৃহলায়ণক প্রভৃত্তি উল্লেখযোগ্য আরণ্যক।

উপনিষদ

আরণ্যক যে অধ্যাজবিদ্যার সুচনা, উপলিষদে জা বিস্তার ও গভীৱতা লাভ করেছে। উপ-নিসদ + বিশ = উপনিষদ।

এখানে উপ অর্থ সমীপে বা নিকটে, নি অর্থ নিশ্চয়, সদ ধাছুৰ অর্থ অবস্থান। অর্থাৎ গরুর নিকটে বসে নিশ্চয়ের সঙ্গে যে জ্ঞান অর্পন করা হয় তাকে উপনিষদ বলে। কিন্তু এ কথায় উপনিষসের বিষয় স্পষ্ট হয় না। জীবের মূলসত্তা হচ্ছে তার আত্মা। এই আত্মা পরমাত্মা বা ব্রহ্মেরই অংশ। সুতরাং জীৰ ব্ৰহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ব্রহ্ম নিরাকার। আ্ারপে জীবের মধ্যে তার অবস্থান। তিনিই সবকিছুর মূলে। এই ব্রহ্মজ্ঞল উপনিষদের বিষয়।

উপনিষদের সংখ্যা শতাধিক। সেগুলাের মধ্যে ১২ খানা প্রাচীন উপনিষদ। বাকিগুলাে পরবর্তীকালের। মহাভারতের অন্তর্গত হয়েও পৃথক গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে উপনিষদের সার বলা হয়েছে। ঐতরেয়, কঠ, কেন, ছান্দোগ্য প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য উপনিষদ।

বেদাঙ্গ

বেদপাঠের সহায়ক হিসেবে আরও কয়েক রকমের রচনা রয়েছে। বেদপাঠের অঙ্গ বলে এগুলােকে বলা হয় বেদাঙ্গ। বেদাঙ্গ বেদপাঠের সহায়ক শাস্ত্র। বেদাঙ্গের জ্ঞান না থাকলে বেদ অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হয় না। বেদাঙ্গগুলাে সূত্রাকারে রচিত। বেদাঙ্গ ছয় প্রকার, যথা – শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরবক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। এই ছয়টিকে একসঙ্গে বলা হয় ষড়ঙ্গ।

১. শিক্ষা – ‘শিক্ষা’ শব্দটি এখানে সামগ্রিকভাবে বিদ্যার্জন বা জ্ঞানার্জন অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। ‘শিক্ষা বলতে এখানে বােঝানাে হয়েছে ধ্বনিতত্ত্ব, বিশেষকরে উচ্চারণত্ত্বসহ নির্ভুলভাবে বৈদিক শব্দ উচ্চারণের পদ্ধতিকে।

২. কল্প – যজ্ঞাদি কর্মকাণ্ড যার দ্বারা কল্পিত ও সমর্থিত হয় তাকে কল্প বলা হয়। কল্প’ হচ্ছে। নির্ভুলভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকাণ্ড অনুষ্ঠানের পদ্ধতি।

৩) ব্যাকরণ: ব্যাকরণে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে সূত্রায়িত করা হয় এবং শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা হয়। ভাষা ব্যবহারের সময় তার অর্থশুদ্ধির জন্য ব্যাকরণ পাঠ করা প্রয়ােজন। সে কারণে ব্যাকরণও একটি বেদাঙ্গ।

৪. নিরুক্ত: নিরুক্ত নামক বেদাঙ্গে বেদে ব্যবহৃত শব্দাবলির উৎপত্তি, অর্থ প্রভৃতির আলােচনা করা হয়েছে।

৫. ছন্দ: বেদাঙ্গের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে ছন্দ। বেদের যে-সকল মন্ত্র ছন্দবদ্ধ সেগুলাের অর্থবােধ এবং যথাযথ আবৃত্তির জন্য ছন্দের জ্ঞান অপরিহার্য।

৬. জ্যোতিষ: বৈদিক যুগে বিশেষ-বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে বিশেষ-বিশেষ যজ্ঞ করার ব্যবস্থা ছিল। জ্যোতিষে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। যজ্ঞে ফলসিদ্ধির জন্য জ্যোতিষের আবশ্যক।

চতুর্বেদের বিষয়বস্তু

বেদ ঈশ্বরের বাণী। ঋষি মনু বলেছেন – ‘বেদঃ অখিলধর্মমূলম’ – অর্থাৎ বেদ হচ্ছে সকল ধর্মের মূল। এখানে সত্য ও জ্ঞানের নানা বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। এ সত্য বা জ্ঞান অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। বেদে বিভিন্নভাবে ঈশ্বর ও দেবতাদের স্তুতি বা প্রশংসা করা হয়েছে। ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তিকে দেবতা বলে।

অগ্নি, বায়ু, উষা, রাত্রি প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা উপলদ্ধি করে বৈদিক ঋষিগণ তাঁদের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের স্তুতি ও বন্দনা ঋষিদের কণ্ঠে কবিতার আকারে বাণীরূপ পেয়েছে। গভীর ধ্যানে এই বাণী বা কবিতা ঋষিগণ ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন। তাই ঋষিরা বলেছেন, তারা বেদ দর্শন করেছেন।

এজন্য বেদকে বলা হয় অপৌরুষেয় । অর্থাৎ বেদ কোনাে পুরুষ বা ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট নয়, তা ধ্যানে দৃষ্ট। বেদের সঙ্গে দেবতাদের প্রসঙ্গ যুক্ত। বেদের বিষয়কে বলা হয় দেবতা। বিভিন্ন স্তব-স্তুতির মাধ্যমে ঋষিগণ দেবতাদের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। বৈদিক যুগে উপাসনার পদ্ধতি ছিল যজ্ঞ বা হােমভিত্তিক।

তখনও মূর্তি বা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে উপাসনা করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়নি। ঋষিগণ দেবতাদের শক্তি স্মরণ করে মন্ত্রের মাধ্যমে উপাসনা করতেন এবং অগ্নি প্রজ্বলিত করে দেবতাকে আহ্বান করতেন। ঋষিগণ বৈদিক দেবতাদের তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছেন, অন্তরিক্ষলােকের দেবতা এবং ৩. পৃথিবী বা মর্তলােকের দেবতা। যথা ১. স্বর্গের দেবতা, ২.অন্তরিক্ষলােকের দেবতা এবং ৩. পৃথিবী বা মর্তলােকের দেবতা।

স্বর্গের দেবতা:

স্বর্গের দেবতাদের ক্ষমতাই শুধু বােঝা যায়। এ শ্রেণির দেবতারা মর্তে বা পৃথিবীতে আসেন না। তাঁরা অনেক দূরে অবস্থান করেন। এমন দেবতারা হলেন বিষ্ণু, সূর্য, বরুণ প্রভৃতি

অন্তরিক্ষলােকের দেবতা

অন্তরিক্ষলােকের দেবতাগণ স্বর্গ ও মর্তলােকের মাঝখানে অবস্থান করেন। তারা মর্তে আসেন, কিন্তু থাকেন না। এরূপ দেবতারা হলেন ইন্দ্র, বায়ু, রুদ্র প্রমুখ।

মর্তলােকের দেবতা

মর্তের দেবতাদের দেখা যায়। তারা পৃথিবীতে অবস্থানও করেন। এমন দেবতা হলেন অগ্নি, অপ, সােম প্রমুখ। অগ্নির মাধ্যমে অন্য দেবতাদের মর্তে আহ্বান করে আনা হয়। আগুন জ্বালিয়ে বেদের শ্লোক উচ্চারণ করে দেবতাকে আহ্বান জানানাে এবং প্রার্থনা করাকে বলা হয় যজ্ঞ। যজ্ঞের সময় উচ্চারিত বেদের এই শ্লোককে বলা হয় মন্ত্র। এছাড়া রয়েছে গান।

বেদের কোনাে-কোনাে শ্লোকে সুর আরােপ করে যজ্ঞের সময় গাওয়া হতা। এগুলােকে বলা হয় সাম। সাম মানে গান। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রকার কথাও বেদে উল্লিখিত হয়েছে।

আরোও পড়ুনঃ ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং জ্ঞানী, যােগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর

বেদের প্রকারভেদ

বেদ প্রথমে অবিভক্ত আকারেই ছিল। পরবর্তীকালে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদকে বিভক্ত করেন। এজন্য তাঁর এক নাম হয়েছে বেদব্যাস। তিনি বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করেন। এগুলােকে বলা হয় সংহিতা। সংহিতা মানে সংগ্রহ বা সংকলন। সংহিতাগুলাে হচ্ছে- ১. ঋথেদ-সংহিতা, ২. যজুর্বেদ-সংহিতা, ৩. সামবেদ- সংহিতা এবং ৪. অথর্ববেদ-সংহিতা। সংহিতাগুলাের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেওয়া হলাে:

১. ঋগবেদ-সংহিতা

ঋক্ শব্দের অর্থ স্তুতি। ঋগুলােকে মন্ত্রও বলা হয়। এই ঋক্ বা মন্ত্রগুলাে হচ্ছে তিন বা চার পংক্তির ছােট ছােট কবিতা বা শ্লোক। এক সময়ে কবিতার মতাে ঋগৃবেদের এই মন্ত্রগুলাে আবৃত্তি করা হতাে। সমস্ত ঋগবেদে এ-রকম ১০,৪৭২টি ঋক্ বা মন্ত্র রয়েছে।

একই দেবতার উদ্দেশে রচিত মন্ত্ৰসমূহকে একত্রে বলা হয় সূক্ত, যেমন- ইন্দ্রসূক্ত। সমস্ত ঋগ্‌বেদকে দশটি মণ্ডলে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডলে কয়েকটি সূক্ত এবং প্রতিটি সূত্তে কয়েকটি ঋক্ রয়েছে। ঋগবেদে মােট ১,০২৮টি সূক্ত রয়েছে। সূক্তগুলােতে দেবতাদের স্তুতি করা হয়েছে এবং তাঁদের কাছে সুখ ও শান্তির জন্য প্রার্থনা জানানাে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইন্দ্র হচ্ছেন বৃষ্টি ও শিশিরের দেবতা। ইন্দ্রের প্রশংসা করে একটি ঋকে বলা হয়েছে:

সরলার্থ: ইন্দ্র আমাদের সহায়। শত্রুদের কাছে বজ্রধারী। আমরা অনেক সম্পদের জন্য কিংবা অল্প সম্পদের জন্যও ইন্দ্রকে আহ্বান করি।

এই মন্ত্রের দেবতা ইন্দ্র। ইন্দ্রকে নিজেদের সহায় এবং শত্রুদের কাছে শাস্তিদানকারী বজ্র নামক অস্ত্রধারী বলে স্তুতি করা হয়েছে এবং তাঁর কাছে ধনসম্পদ প্রার্থনা করা হয়েছে। এই ঋক মন্ত্রটির দ্রষ্টা হলেন ঋষি মধুচ্ছন্দা।

২. যজুর্বেদ-সংহিতা

যজুঃ’ মানে যজ্ঞের মন্ত্র । প্রাচীনকালের ঋষিরা বেদ থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করে বা আবৃত্তি করে ধর্মানুষ্ঠান বা যাগযজ্ঞ করতেন। যজ্ঞ করার সময় উদ্দিষ্ট দেবতার জন্য সুনির্দিষ্ট মন্ত্র পাঠ করা হতাে। এভাবে যজ্ঞে ব্যবহৃত মন্ত্রগুলাে সংগ্রহ করে যে-বেদে সংকলন করা হয়েছে তাকে যজুর্বেদ সংহিতা বলা হয়।

যজ্ঞানুষ্ঠানের নিয়ম-পদ্ধতি যজুর্বেদে সংকলিত হয়েছে। যজ্ঞকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বর্ষপঞ্জি বা ঋতু সম্পর্কিত ধারণা। বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন সময়ব্যাপী যজ্ঞ করা হতাে। কোনাে যজ্ঞ ছিল দৈনন্দিন, কোনাে যজ্ঞ ছিল সপ্তাহব্যাপী, কোনাে যজ্ঞ ছিল পক্ষকালব্যাপী।

আবার কোনাে যজ্ঞ বর্ষব্যাপী, এমনকি দ্বাদশবর্ষব্যাপীও অনুষ্ঠিত হতাে । একেক প্রকার যজ্ঞের জন্য একেক প্রকার বেদী নির্মাণ করা হতাে। এই নির্মাণ-কৌশল থেকেই জ্যামিতি বা ভূমি পরিমাপ বিদ্যার উদ্ভব ঘটেছে। ঋগ্বেদ ও সামবেদ পদ্যে রচিত। কিন্তু যজুর্বেদে গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিই ব্যবহৃত হয়েছে।

যজুর্বেদ দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত, যথা- ১. কৃষ্ণযজুর্বেদ ও ২. শুক্লযজুর্বেদ। কৃষ্ণযজুর্বেদের অপর নাম তৈত্তিরীয়-সংহিতা। শুক্লযজুর্বেদের অপর নাম বাজসনেয়ী-সংহিতা। কৃষ্ণযজুর্বেদে ৭টি কাণ্ড ও ২১৮৪টি মন্ত্র রয়েছে। আর শুক্লযজুর্বেদে রয়েছে ৪০টি অধ্যায় এবং ১৯১৫টি মন্ত্র ।

৩. সামবেদ-সংহিতা

সাম’ শব্দের অর্থ গান। যজ্ঞ করার সময় কোনাে-কোনাে ঋক্ বা মন্ত্র সুর করে গাওয়া হতাে। এরূপ মন্ত্রগুলােকে বলা হয় সাম। যে-বেদে এই সাম মন্ত্ৰসমূহ সংকলিত হয়েছে তাকে বলা হয় সামবেদ-সংহিতা। সামবেদ থেকে প্রাচীনকালের সংগীত সম্পর্কে জ্ঞানলাভ হয়। আমরা যে সুর করে গান গাই, তার অন্যতম আদি উৎস এই সামবেদ। ষড়জ, ঋষভ প্রভৃতি স্বরের (সরগম) উৎসও সামবেদ।

প্রধানত ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলােকেই সুর দিয়ে গানের আকারে রূপদান করা হয়েছে। সামবেদ-সংহিতার মন্ত্রসংখ্যা ১৮১০টি। এগুলাের মধ্যে ৭৫টি ছাড়া বাকিগুলাে ঋগ্বেদ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। অথর্ববেদ-সংহিতা বেদের চতুর্থ ভাগ হচ্ছে অথর্ববেদ ।

৪. অথর্ববেদ-সংহিতা

আধ্যাত্মিক ও জাগতিক নানা প্রকার জ্ঞানের সংগ্রহ। অথর্ববেদের প্রাচীন নাম অথর্বাঙ্গিরস। অথর্ব বলতে ভেষজ বিদ্যা, শান্তি, পুষ্টি প্রভৃতি মঙ্গলক্রিয়া বোঝায়। আঙ্গিরস বলতে শত্রুবধ এবং বশীভূত করার উপায়, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি বােঝায় । প্রাচীনকালের চিকিৎসা পদ্ধতির আদি পরিচায়ক হিসেবে অথর্ববেদ বিখ্যাত।

অথর্ববেদে নানা প্রকার ব্যাধির প্রতিকারের উপায়স্বরূপ নানা প্রকার বৃক্ষ, লতা, গুল্ম প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ নামে পরিচিত চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি উৎস এই অথববেদ। এছাড়া এই বেদে অস্থিবিদ্যা ও শল্যবিদ্যারও (সার্জারি) উল্লেখ আছে।

অথর্ববেদ-সংহিতা কুড়িটি কাণ্ড, ৭৩১টি সূক্ত এবং প্রায় ৬০০০ মন্ত্র নিয়ে রচিত। অথর্ববেদ গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিতে রচিত। তবে পদ্যই বেশি। ছয় ভাগের এক ভাগমাত্র গদ্যে রচিত।

Leave a Comment