ঈশ্বর এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তিনিই বিশ্ববরহ্মাণ্ডের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। দেব-দেবীরা তাঁরই গুণ বা শক্তির প্রতিভূ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঈশ্বরের একত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে –
একো দেবঃ সর্বভূতেষু গুঢ়ঃ
সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।
কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ
সাক্ষী চেতা কেবলাে নির্গুণশ্চ॥ (৬/১১)
সরলার্থ: এক ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সকল জীবের মধ্যে প্রচ্ছন্নরূপে অবস্থান করছেন। তিনি সর্বব্যাপী, সকল জীবের আত্মা, সকল কাজের কর্তা এবং সকল জীবের আবাসস্থল। তিনি সকল কিছু দেখেন, সকল জীবকে চেতনা দান করেন।
তিনি নিরাকার-নির্গুণ ব্রহ্ম। ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত করছেন। গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রসমূহ এ মহাকাশে নির্দিষ্ট গতিপথে আবর্তিত হচ্ছে। জীব ও জড়বস্তু সবকিছুই একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। জীব জন্মলাভ করছে, আবার আয়ুশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহত্যাগ করছে। হিন্দুধর্মানুসারে জীবের দেহের ধ্বংস আছে, কিন্তু জীবাত্মার ধ্বংস নেই।
পৃথিবীর সকল জীব ও জড়ের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। একজন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক না থাকলে এ মহাবিশ্বের সকল কিছু শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হতাে না। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একাধিক ঈশ্বর থাকলে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলাে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে পারত না।
সকল জীব ও জড়ের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকত না। ধ্যান-ধারণা ও মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। ঈশ্বর নিরাকার। তাঁকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে অনুভব করা যায়। যেমন বিদ্যুৎ চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার কাজের মাধ্যমে তাকে অনুভব করা যায়। ধার্মিকতা ও সততা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস আনয়ন করে। এর মাধ্যমে নৈতিক চিন্তাবােধ বিকশিত হয় উপনিষদে উল্লেখ আছে যে, সূর্য তাকে প্রকাশ করতে পারে না; চন্দ্র, তারকা, ঈশ্বরের স্বরূপ বিদ্যুৎ, অগ্নিও তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না; সর্বত্র তিনিই প্রকাশিত আছেন এবং সকল কিছুই তিনি প্রকাশ করেন।
উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রাণী ও অপ্রাণী যে-কোনাে বিষয় বা পদার্থ যে-স্থান থেকে জন্মলাভ করে, মৃত্যু বা ধ্বংসের মাধ্যমে আবার যার কাছে ফিরে যায়, তিনিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর।
ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। তিনি সবকিছু জানেন। তাই তিনি পুণ্যাত্মাকে সুখী করেন, অপরাধীকে শাস্তি দেন এবং অদৃশ্যভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন । তিনি সবকিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রক।
ব্ৰহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও জীবাত্মা
ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম রয়েছে এবং আমরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকি। যেমন- ব্ৰহ্ম, পরমাত্মা, ঈশ্বর ও ভগবান। ঋষিরা ঈশ্বরকে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, ভগবান ও আত্মা বা জীবাত্মারূপে উপলব্ধি করেছেন এবং তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা ঋষিদের বর্ণনানুসারে ব্রহ্ম, ঈশ্বর ও ভগবানের পরিচয় জানব।
ব্রহ্ম
হিন্দুধর্ম অনুসারে বিশ্বব্ক্মাণ্ত ব্রহ্মেরই সৃষ্টি ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সকল জীব ও জড়ের স্রষ্টা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু ঘটছে, সবই তাঁর কারণে। নিরাকার ব্রহ্মকে বােঝাবার জন্য ঋষিরা ওঁ-এ প্রতীকী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ বৃহৎ। বৃহত্ত্বাৎ ব্রহ্ম, বা বৃহৎ বলেই তাঁর নাম ব্রহ্ম। আবার ব্রহ্মকে বলা হয়েছে। তিনি সত্য। অর্থাৎ সত্যই ব্রহ্ম। কোনাে-কোনাে ঋষি আবার বলেছেন, ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। আমাদের আনন্দ ব্রহ্ষেরই আনন্দ। এই ব্রহ্মকেই আবার বলা হয়েছে পরমাত্মা।
ঈশ্বর
ঈশ্বর শব্দের অর্থ প্রভু। তিনি সকল জীবের সকল কাজের প্রভুত্বকারী। ব্রহ্ম যখন জীবের ওপর প্রভুত্ব করেন এবং জীবকুলে সকল কাজ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তাঁকে ঈশ্বর বলা হয়। নিরাকার ঈশ্বর তার নিজের ইচ্ছা অনুসারে নিজের আনন্দের জন্য নিজেকেই নানারূপে প্রকাশ করেন। ঈশ্বরই অবতার। তিনি যখন দুষ্টের দমন করেন এবং ন্যায়-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে নেমে আসেন, তখন তাঁকে অবতার বলে। যেমন – মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, রাম প্রভৃতি।
আবার ঈশ্বরের কোনাে গুণ বা শক্তি যখন আকার ধারণ করে, তখন তাঁকে দেবতা বা দেব-দেবী বলে। যেমন-শক্তির দেবী দুর্গা, বিদ্যার দেবী সরস্বতী ইত্যাদি। ঈশ্বর এক। বিভিন্ন অবতার বা দেব-দেবী এক ঈশ্বরেরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ। সবই এক ঈশ্বরের লীলা
ভগবান
ঈশ্বরকে আমরা সর্বশক্তিমান হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করি সর্বশক্তিমান বা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বলে আমরা তাকে সমীহ করি। তাকে ঘিরে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভালােবাসার সৃষ্টি হয়। ভালােবাসার অপর নাম মায়া। এই মায়ার জালে সকল জীব আবদ্ধ। আমাদের কোনােকিছুর অভাব ঘটলে বা আমরা গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হলে ঈশ্বর আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হন। তবে আমরা তাঁকে দেখতে পাই না, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি। ভক্তের নিকট ঈশ্বর ভগবানরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। ভক্তের কাছে ভগবান আনন্দময়। ভগ’ শব্দটির অর্থ ঐশ্বর্য বা গুণ । ঈশ্বরের ছয়টি গুণ – ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্ৰী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ছয়টি ভগ বা ঐশ্বর্য আছে বলে ঈশ্বরকে ভগবান বলা হয়। ভগবান ভক্তের ডাকে সাড়া দেন ও লীলা করেন । সুতরাং, ঈশ্বর যখন ভক্তদের কৃপা করেন, তাদের দুঃখ দূর করে তাদের মঙ্গল করেন, তখন তাঁকে ভগবান বলা হয়।
জীবাত্মা
আত্মা বা পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে অবস্থান করেন তখন তাকে বলা হয় জীবাত্মা। জীবাত্মারূপে তিনি মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ সবকিছুর মধ্যেই অবস্থান করেন। তাই ঈশ্বরভক্ত যারা তারা সব জীবকেই সমান দৃষ্টিতে দেখেন। কারাে প্রতি হিংসা করেন না। কারণ জীবের প্রতি হিংসা করলে ঈশ্বরকেই হিংসা করা হয়।
আরোও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান (পর্ব ১)
জ্ঞানী, যােগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর
জ্ঞানী, যােগী ও ভক্ত ঈশ্বরকে নিজ-নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। জ্ঞানী জ্ঞানের দৃষ্টিতে, যােগী যােগসাধনার মধ্য দিয়ে এবং ভক্ত ভক্তির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন । ঈশ্বরকে যিনি জ্ঞানের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তিনিই জ্ঞানী। ধর্মপালন ও ঈশ্বরের সান্নধ্য লাভের জন্য গীতায় বিভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে।
ঈশ্বর লাভের এ-সকল পথকে যােগসাধনা বলে । যারা আত্মার উপাসনা করেন এবং যােগসাধনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তাঁদের যােগী বলা হয়। আবার যারা ভক্তির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করেন তাঁরা হলেন ভক্ত। এখন জ্ঞানী, যােগী ও ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের যে-স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে, সংক্ষেপে তার আলােচনা করা হলাে ।
জ্ঞানীর দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যারা সকল বিষয়-বাসনা পরিত্যাগ করে কেবল সর্বব্যাপী ও নিরাকার ব্রহ্মকে উপাসনা করেন এবং ব্রহ্মেই সম্ভুষ্ট থাকেন, তাঁদের জ্ঞানী বলা হয়। জ্ঞানীদের কাছে ঈশ্বরই ব্রহ্ম, যিনি এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা মানুষের জন্য, জীবের জন্য এবং ঈশ্বরের ভালােবাসা লাভের জন্য কাজ করেন। জ্ঞানযােগে তারা এসব করেন। জ্ঞান অর্থ জানা, যােগ অর্থ যুক্ত হওয়া। তাই জ্ঞানী শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কোনাে বিষয় সম্পর্কে জানার সঙ্গে যুক্ত যিনি ।
জ্ঞান দুই প্রকার – বিদ্যা ও অবিদ্যা। বিদ্যা ও অবিদ্যা যথাক্রমে পরা ও অপরা নামেও পরিচিত। বিদ্যার দ্বারা ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ হয়। সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধ হয় । জাগতিক বিষয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয় এবং মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। অবিদ্যার দ্বরা জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় না। তাই ধর্মশাস্ত্রে জ্ঞানী বলতে আত্মা বা ব্রহ্ম সম্বন্ধে জ্ঞানী ব্যক্তিদের বােঝানাে হয়েছে।
যােগীর দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যারা একাগ্রতা সহকারে মনের অন্তঃস্থল থেকে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেন, সকল কামনা-বাসনা দূর করতে সমর্থ হন, তাঁদের যােগী বলা হয়। এদের মুখ্য উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ । যােগীদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর পরমাত্মা। এই পরমাত্মাই জীবাত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই যােগীর কাছে জীবও ঈশ্বর।
মহাযােগী ও মহাজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই বহুরূপে ঈশ্বররের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে তার অমর বাণী – ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। অর্থাৎ জীবের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়।
ভক্তের দৃষ্টিতে ঈশ্বর
যারা সংসারের বিষয় ও বৈষয়িক কর্মের মধ্যে থেকে সর্বশক্তিমান ভগবানের উপাসনা করেন, তাদের ভক্ত বলা হয়। ভক্তেরা সর্বজীবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেন এবং সেভাবেই জীবসেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা করেন। ভক্তের নিকট ঈশ্বর ভগবান। তিনি রসময়, আনন্দময় ও গুণময়।
কখনও কখনও ভগবান ভক্তের সেবা করেন। ভক্তের বােঝা বহন করেন । ভক্তও ভগবানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। নিজের সকল কাজকে ভগবানের কাজ হিসেবে সম্পাদন করেন। ভগবানের প্রতি ভক্তের মনে নিবিড় ও গভীর ভালােবাসা বিরাজ করে। শুধু তাই নয়, তাঁর সৃষ্টিকেও যাতে গভীরভাবে ভালােবাসতে পারেন সেজন্য ভক্ত ভগবানের নিকট প্রার্থনা করেন।